বিবমিষা

বিবমিষা

খাজাসাহেব নতুন প্রমোশন পেয়েছেন। এখন তিনি সরকারের গেজেটভুক্ত প্রথমশ্রেণির কর্মকর্তা। চাকরিতে জয়েন করেছিলেন তৃতীয় শ্রেণি হিসাবে। আজকে তিনি নিজের একটা অফিসে বসেন। তার অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণির ৭ জন কর্মকর্তা, তৃতীয় শ্রেণির ৪ জন ক্লার্ক, ২ জন অফিস সহকারী, ২ ড্রাইভার এবং ৫ জন সিপাই কাজ করে।

নিজের উন্নতিতে তিনি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান। সোডা ওয়াটার ছাড়াই তৃপ্তির একটা সুখ ঢেকুর ওঠে। তার কাজের যেই ধারা, এতে তিনি নিজেকে সতীর্থদের কাছে পুলিশের ওসি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। থানার ওসিরা ক্যাডার না হয়েও যেমন ক্ষমতাবান, তার সার্ভিসে তিনিও সমপর্যায়ের ক্ষমতাবান।

খাজাসাহেব সময়মতো অফিসে আসেন প্রতিদিন। অনেক ডিসিপ্লিনড। অধীনস্থরা সবাই তার ব্যবহারে মুগ্ধ। সচরাচর রাগ করেন না। কিন্তু কাল বিকাল থেকে তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।

মেজাজ খারাপের হেতু টেবিলের পাশে স্তুপ করে রাখা ২০ টা বই। লেখক তার সাবেক কমান্ডিং অফিসার। এই লোক এখন রিটায়ার্ড। ইনার শখ হয়েছিল বই লিখবেন, উদ্দেশ্য কিছু পয়সা কামানো। একটা বই কাল একটু নেড়েচেড়ে দেখেছেন খাজাসাহেব। একেবারে অখাদ্য। এই জিনিস কেউ পড়বে না, বিক্রিও হবে না।

মানুষ গল্প উপন্যাসের বই লেখে, সেগুলোই পড়ে না। আর এ তো আইনকানুন বিষয়ক। শুষ্কং কাষ্ঠং বিষয়। তাও আবার মৌলিক কিছু নয়, এদিক সেদিক থেকে ধার করা জগাখিচুড়ি মার্কা লেখা। সংকলনকে নিজের লেখা বলে চালানোর অপচেষ্টা। অবসরের পরে মাথায় ভূত চেপেছে বই বেচে দুপয়সা কামাবেন৷ জুনিয়ররা আছে। তারাই ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এইধরনের লোকজন ভুলে যান, চেয়ার না থাকলে কেউ পুছে না। যতক্ষণ চেয়ারে উপবিষ্ট থাকবেন, সেপর্যন্তই আপনার দাম টিকে থাকে। লোকজন সালাম দেয়, সম্মান করে তার চেয়ারটাকে, ব্যক্তিমানুষকে না।

যতদিন চাকরি করেছেন, মানুষ তাকে সহ্য করেছে, ব্যবহার ছিল অতীব খারাপ। মানুষকে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, গালিগালাজ তো খুবই নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল।

খাজাসাহেবকে একবার ঝড়বৃষ্টির রাতে ডিউটিতে পাঠিয়েছিলেন। খাজা তখন অসুস্থ, ১০২ জ্বর ছিল তার। অনেক অনুরোধ করেও মহোদয়কে ম্যানেজ করতে পারেননি। কাকভেজা হয়ে পরে নিউমোনিয়া বাধিয়ে দুইমাস বেডরেস্টে থাকতে হয়েছিল৷

ওই লোকের অধীনস্থদের যন্ত্রণা দেয়ার পেছনে মূল কার‍ণ ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ। খাজা তখন ছোট কর্মচারী ছিলেন, আদেশ পালন করেছেন বাধ্য হয়ে। এমন তো কতই করেছেন অন্য কর্তাদের আদেশেও। তারপরেও এই লোকের আদেশ আসলে সবাই বুঝে যাইত এখানে অনেক বড় আকারের কিন্তু রয়েছে। এইসব কারণে অফিসের আসবাবপত্রগুলোও মনে হয় তাকে পছন্দ করত না।

অবসরের পরে ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রদের হাতে পায়ে ধরে বইগুলো বিক্রির জন্য সারাদেশে পাঠিয়েছেন। ঢোল কোম্পানির মলমের মত পুশ সেলিং৷ এটা ছোটলোকি ছাড়া আর কিছুই না।

বসে থাকতে থাকতে খাজা একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। সিপাই মাজহারকে ডাকলেন। মাজহার অনেক মার্জিত চেহারার। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মত দেখতে। লেখককে এই সাদা রঙের সিপাইয়ের পোশাকে কল্পনা করতে এত মেজাজ খারাপের মাঝেও খাজাসাহেবের হাসি পেল। তিনি মাজহারকে বললেন বইগুলো বাইরের টয়লেটের কাছে নিতে।

সেখানে নেয়া হলে আদেশ দিলেন একটা একটা করে পাতা ছিড়তে। মাজহার মিয়া অবাক চোখে তাকে দেখল। পাতা ছেড়া শুরু করল সে। শেষ হলে এইবার এই কাগজের টুকরোগুলো সেই পরিত্যক্ত টয়লেটে ঢুকাতে বললেন। মাজহারের বিস্ময় সীমা ছাড়াচ্ছে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করা যাবে না। কর্তৃপক্ষের আদেশ অবশ্য পালনীয়।

২০ টা বইয়ের ছেড়াপাতাও কম না। সব এখন টয়লেটের ময়লার সাথে মাখামাখি। এবার খাজাসাহেব তাকে বললেন এগুলোর উপরে প্রস্রাব করতে৷ মাজহারের চোখে করুণ দৃষ্টি। কিন্তু বস বলেছেন করতে তো হবেই। দরজার আড়ালে গিয়ে কাজ সারল সে।

বের হয়ে আসতেই খাজাসাহেব বললেন, এখন থেকে একমাস সময় পর্যন্ত অফিসের যত কর্মচারী আছে, সবাই দিনে একবার করে হলেও এখানে ঢুকবে। এটা তার নির্দেশ। এর অন্যথা হওয়া যাবে না। তিনি মাঝেমাঝে এসে চেক করে যাবেন।

মাজহার মিয়া মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল। সাহেবদের অদ্ভুত খেয়াল। সে অত মাথা ঘামায় না এসব নিয়ে।

রুমে ফেরত এসে মাজহারকে আবার ডাকলেন। ওকে একটা বিকাশ নম্বর দিয়ে বইয়ের মূল্যবাবদ টাকাটা নির্দিষ্ট একজনকে পাঠাতে বলে দিলেন।

এরপরে বাথরুমে গিয়ে বেসিনে ঘৃণাভরে একদলা থুথু ফেললেন। শব্দ হল- ‘থুহ’।

Your Comment