মোবাইলে এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শুয়ে থেকেই বুঝলাম কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে শরীরে। মনে হচ্ছে মাথাটা কেউ খামচি দিয়ে ধরে রেখেছে। চোখ পিটপিট করে কাহিনী বুঝার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম জ্বর আসছে। আচ্ছা, দুইদিন পর পর জ্বর আসে কেন? এর চেয়ে ভালো কিছু আসতে পারে না?
ঠিক করে ফেললাম বাইরে বের হব। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছি। একা ঘুরতে গেলে এই একটা সমস্যা। গন্তব্য ঠিক করতে হয়। দুইজনে এই সমস্যা নেই। একদিকে যাত্রা শুরু করলেই হয়।
আশুলিয়ার দিকেই যাই। অনেক দিন যাওয়া হয় না। নতুন গজিয়ে ওঠা ফানপ্লেসগুলা ভালো লাগে না। অনেক মানুষের ভীড়। আশুলিয়ার এখন আগের সৌন্দর্য নেই। তারপরেও বিশাল ধ্বংসস্তূপের দিকেও তো মানুষ কিছুক্ষণের ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এটা মানুষের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। অন্তুর গায়ে হলুদের রাতের পরদিন বারিধারা থেকে ভোর ৫ টায় গাড়ি নিয়ে আসছিলাম একবার সূর্যোদয় দেখতে। তুরাগ নদী তখন কানায় কানায় পূর্ণ। ভেবে রেখেছিলাম পরে আবারো আসব একই সময়ে, অন্য কাউকে সাথে নিয়ে।
গন্তব্য ঠিক করতে পেরে ভালোই লাগছে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে মাথাব্যথাটা আরও বেড়ে গেছে।
বিরুলিয়া ব্রিজে এসে একটা ছোট্ট টঙে বসে চা খেতে নামলাম। গন্তব্য পরিবর্তন করবো কিনা ভাবতেছি। আশুলিয়া পর্যন্ত আর যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। চা খেতে খেতে জীবনঘনিষ্ঠ একটা জ্ঞান লাভ হইল- ‘তুমি যতই গন্তব্য ঠিক করনা কেন, আসল গন্তব্য উপরওয়ালা ঠিক করে রেখেছেন।’
এখন মনে হচ্ছে, যাই মাজহার মিয়ারে দেখে আসি। তার দোকান ব্র্যাক সিডিএমের কাছেই বস্তিতে।
মাজহার মিয়া এখন পিঁয়াজু বিক্রি করে। আগে রিক্সা চালাইত। ব্র্যাকের এই অফিসটার কারণে বিক্রিবাট্টা ভালই হয়।
ওর সাথে পরিচয় হঠাত করেই। ২-৩ বছর আগে আমি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম আজকের মতই। দেখি পাশে লুঙ্গিপড়া এক লোক তার মেয়ের সাথে এসে দাঁড়াল। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, রিকশা চালায়। তার মেয়ের অনেক শখ হইসে আইসক্রিম খাওয়ার। বাবার লুঙ্গি ধরে কান্নাকাটি। বাবা আর কি করবে অসহায় চোখে একবার মেয়ের দিকে আরেকবার দোকানীর দিকে তাকাচ্ছে। কি মনে হল, তখন বাপ মেয়েরে আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করে কিসের জন্য খাওয়াইতেছেন। বললাম আমি বিদেশ চলে যাচ্ছিতো, সেই উপলক্ষে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছি।
সে বলে, ‘আপনি বিদেশ গেলেগা আমি তো আপ্নের ট্যাকা আর ফেরত দিতে পারমু না।’
তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, যখন আমার মেয়ে হবে তখন তুমিও আইসক্রিম কিনে দিও। শোধবোধ হয়ে যাবে। মাজহার মিয়া অসহায় হয়ে বলে, আপনার মেয়ে খাইবো রিকশাওয়ালার টাকায় কেনা আইসক্রিম? আমি বললাম খাবেনা কেন? আইসক্রিম তো আইসক্রিমই।
মাঝে মাঝে দেখা হয় তার সাথে। ওরে ফোন দিলাম আছে কি না জানতে। সে বলল, দোকানেই আছে। গেলাম তার ওখানে। গরম গরম পিঁয়াজু ভেজে দিল, খেলাম।
পিঁয়াজু খাওয়ার জন্য নাকি জ্বরের জন্য বুঝলাম না, ঘুম আসতে লাগলো খুব। বললাম, ‘মাজহার, শরীরটা ভালো লাগতেছেনা। দেখি একটু শুয়ে থাকি তোমার দোকানের পিছনে।’
শুয়ে পড়লাম ওদের দোকানের ভিতরে দুটো বেঞ্চি জোড়া লাগিয়ে। মাজহারের মেয়েটা একটা ময়লা চাদর এনে দিলো।
জ্বরের ঘোরেই মনে হয় আমার মাথায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটা কবিতার শেষ কয়েকটা লাইন ঘুরপাক খাওয়া শুরু করলো,
“আমারও ইচ্ছে করে খুলে দিই হাতকড়া-বাঁধা হাত
চক্রান্তের খল বুকে কামড় বসাই।
আমারও ইচ্ছে করে
টুকরো টুকরো কোরে কেটে ফেলি তোমার শরীর।।
০৪ বৈশাখ ১৩৯৪ মেথরপট্টি ঢাকা”
ঠিকানাটা ইন্টারেস্টিং আর তারিখটাও বাংলায় লেখা। রুদ্রের মত অমিত প্রতিভাধর একজন কবিকে আমরা কত কম সময় পেয়েছি সেটা ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল।
ঘোরের মধ্যেই শুনছি মাজহার মিয়া তার মেয়েকে বলছে- “ভাইজানের তো অনেক জ্বর! কি যে করি.. হাসপাতালে নিতে হইবো.. কি না কি হইয়া যায়!”
– হ আব্বা। চলেন কাউরে বইলা হাসপাতালে নিয়া যাই।
এই অবস্থার মধ্যেও কিভাবে যেন আমার হাসি চলে আসলো। কে জানে মাজহার মিয়া তার নিজের মেয়ের জ্বর হলে কখনও এভাবে ভেবেছে কিনা, দুশ্চিন্তা করেছে কিনা?
মানবপ্রকৃতি বড়ই রহস্যময়!