মিরপুর থেকে বারিধারা যেতে পাঠাও বাইকে ১৮০ টাকা ভাড়া দেখালো। ঈদের পরেরদিন। ঢাকার রাস্তাঘাট ফাকা। চিন্তা করে দেখলাম, আর কয়টা টাকা খরচ করলে তো উবারের প্রিমিয়াম কারেই যাওয়া যাবে। তাছাড়া আমার প্রোমোকোড আছে, ১০০ টাকা ডিসকাউন্ট, উবারের পক্ষ থেকে ঈদ শুভেচ্ছা। রাইডের রিকুয়েস্ট পাঠানোর দশ মিনিটের মধ্যে কালো রঙের গাড়ি চলে আসলো।
ড্রাইভারের নাম ট্রূকলারে দেয়া Ubar Draivar Mozaharul…মানুষের নাম মাজহারুল হয়, সেটাকে সে কায়দা করে মাজহার বলে। যেহেতু সে ড্রাইভার জাতের, এইজন্য মনে হয় তার নাম মোজাহারুল।
রাস্তায় নেমে ড্রাইভার খুঁজে পাইলাম না। দেখি সামনের বনেট খুলে কেউ কিছু একটা করছে। ঘুরে সামনে আসার পরে ব্যাটারে দেখে তো পুরা টাশকি। এবারের ঈদের ক্রেজ কালো কাবলিসেট পড়া শাহরুখ খান যেন আমার সামনে। আমারো একইজিনিস কেনা হইছে, শ্বশুরবাড়ি থেকে দিছে, ভাগ্য ভাল আজকে পড়ি নাই। নাইলে ভাইজানকে চিমটি দিতে হইত। চুল জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা। কামিজের উপরের বোতাম দুইটা খোলা, চেন দেখা যাচ্ছে। সানগ্লাস চোখে। বুকে অনিল কাপুরের মত লোম নাই। দাড়িগোঁফ কম, মাকুন্দা। সিনেমার পর্দা থেকে ‘রইস’ এর শাহরুখ যেন উবারের গাড়ি নিয়া হাজির আমার খেদমতে।
সংকোচ নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। এত স্মার্ট উবার ড্রাইভারদের গল্প আগে শুনেছি, দেখলাম আজকেই প্রথম। তাও কিং খানের মত স্টাইলিশ। সচরাচর যেটা করি, উবারে উঠে ড্রাইভারের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা….
– মোজাহারুল সাহেব
– হ্যাঁ ভাইয়া বলেন (স্যার বলে নাই কিন্তু, তার মানে প্রফেশনাল ড্রাইভার না)
– গাড়ি কি নিজের?
– জ্বি ভাইয়া, নিজের। (উচ্চারণ রেডিও জকিদের মত। বাংলিশ। নিজের কথাটা শোনাল ‘নীযেরহ্’)
– অফটাইমে রাইড দেন?
– একচুয়ালি, ভাইয়া, আই লাইক ড্রাইভিং। ইটয মাই প্যাশন। আমি তোহ্ আসলে জব করি নাহ্, নাও ফুলটাইম উবারিং করি।
– কিন্তু আপনার গাড়ির ফ্রন্টগ্লাসে তো সরকারি স্টিকার লাগানো। কাউকে না জানিয়ে খেপ মারতেছেন বুঝি?
আমার কথা তার পছন্দ হয়নি। মোজাহারুল ওরফে মাজহারের চেহারায় সেটা বোঝা গেলো । শালার কোন জামানায় আছি, ড্রাইভারদেরও দেখি এখানে আবেগ আছে। ড্রাইভার হেল্পারদেরও যদি আমাদের মত মন থাকে, আবেগ থাকে, তাহলে ওদের সাথে আমাদের পার্থক্য কি? স্ট্রেঞ্জ…
বারিধারার রাস্তা দিয়ে ঢুকছি। অনন্যা মার্কেটের সামনে সিগন্যালে গাড়ির জানালায় এক ভিক্ষুক এগিয়ে আসল। এই ভিক্ষুককে আমি চিনি, প্রায়ই দেখি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মত দেখতে। লেখক সাহেবকে ছেঁড়া লুঙি আর মাথায় টুপি দিয়ে হাতে ভিক্ষার থালা ধরিয়ে দিলে কেউ পার্থক্য ধরতে পারবে না। এব্যাটা কখনো আমার কাছে ভিক্ষা চায় না। কালো গ্লাসের কারণে আমাকে দেখতে পায়নি। নিজের চেহারা দেখানোর জন্যই আমি গ্লাস নামিয়ে বললাম, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?
ভিক্ষুক আমাকে চিনতে পেরেছে। সে কি বুঝলো কে জানে, মুখের সামনে থালাটা এনে শুধু একবার ঝাকালো। এই সিগনালের মানে ‘কিছু দিয়া যান…’
হাহাহা, ভেরি ফানি। তুই ব্যাটা এতদিন ধরেই তো আমাকে দেখতেছিস, আগে তো আমার কাছে ভিক্ষা চাস নাই, আজ আমি গাড়িতে উঠছি দেখে ভিক্ষা চাইতে আসছিস? ভাবছিস কি এই গাড়ি আমার নিজের? না? এতদিন তো এই পথ দিয়ে কত যাতায়াত করলাম, তখন তো দেইখাও দেখতি না, ভিক্ষা চাওয়া তো পরে। গাড়িওয়ালারাই খালি ভিক্ষা দেয়, এই তোর ধারণা? শালা গোলামের বাচ্চা গোলাম …
আমি ওকে ১০০ টাকার একটা নোট দিলাম। দিয়েই গ্লাস উঠিয়ে দিলাম। ১০০ টাকার নোটগুলা আসলে ফিতরার জন্য নেয়া। ফকিরের বাচ্চাটা চকচকে নোটটা পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ওর বিস্ময়মাখা চোখদুটো দেখতে। চোখের কোণা দিয়ে খেয়াল করলাম ব্যাটা মাথায় হাত দিয়ে সালামের ভঙ্গি করে আস্তে আস্তে গাড়ির সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে। চোখেমুখে নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা, কুকুরবেড়ালের চোখে যেমন দেখা যায়। এর পর থেকে জানোয়ারটা আমাকে দেখলে ভিক্ষা চাইবে, সালামও দিবে।
একটু পরেই আমার গন্তব্যস্থান চলে আসলো। ড্রাইভার শাহরুখ (মোজাহারুল/মাজহার) ভাড়া নিয়ে আমাকে বলল, স্যার (এবার আর ভাইয়া না, সুর বদলে গেছে, কথা বলার টোন-ও) কী এইরকম সব ফকিরকেই এই পরিমাণ টাকা দেন। পরিষ্কার কুমিল্লার লোকাল বাচনভঙ্গি, কথাটায় হালকা তেলতেলে ভাব বিদ্যমান। আমি কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে নেমে গেলাম। এই হাসির অর্থ হ্যা/না দুটোই হইতে পারে। এটা বোঝার সামর্থ্য যদিও মাজহারের নেই।
মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি, ‘তুমি শালা ছোটলোক, কাবলিওয়ালা সেজেছো! দাঁড়াও তোমাকে আগে রেটিংয়ে ওয়ান স্টার দিবো, সাথে উবার ইউজার গ্রুপে তোমার নামে বানিয়ে বানিয়ে নেগেটিভ রিভিউও দিয়ে দিব! স্টিকারওয়ালা গাড়ি মুফতে চালিয়ে খেপ মারা তোমার বন্ধ কাল থেকে, ছোট্টবন্ধু….