আমরা কোন কিছুর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গেলেই সাধারণত ফুলের সাথে তুলনা করি। কেননা, ফুলের চেয়ে বেশি সুন্দর আর মনোহর বুঝি দুনিয়াতে আর কিছুই নেই। আফসোসের ব্যাপার হলো, কিছু অনন্য সুন্দর ফুলের অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবীতে যেগুলো পাওয়া তো দূরের কথা, একবার চোখের দেখাও দেখা সম্ভব নয় বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে। কেননা, কিছু ফুল এত বেশি দুর্লভ যে ইচ্ছা করলেই সেগুলোর দেখা পাওয়া যায় না। পৃথিবীর এমন কিছু বিরল ফুলের গল্প নিয়েই সাজানো আমাদের আজকের এই আয়োজন-
১. মিডলমিস্ট রেড (Middlemist red)
এই অসম্ভব সুন্দর মিডলমিস্ট ফুলটি হলো পৃথিবীর সবথেকে বিরল ফুল। এর থেকেও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে বর্তমানে মাত্র দু’টি জায়গায় এ ফুল দেখতে পাওয়া যায়, নিউজিল্যান্ডের একটি বাগানে এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন হাউসে। যুক্তরাষ্ট্রের এক নার্সারির মালিক জন মিডলমিস্ট ১৮০৪ সালে এ অসাধারণ ফুলটি চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আনেন। এর পরই চীন থেকে এ ফুলটি চিরতরে হারিয়ে যায়।
সেসময় ফুলকে বিলাসদ্রব্য হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাই তখন, লন্ডনের একটি বাগানে এ ফুল চাষ করা হয়েছিল। মিডলমিস্ট দেখতে অনেকটা গোলাপের মত লাল, যার কিনারায় গাঢ় গোলাপী আভা দেখতে পাওয়া যায়। উদ্ভিদবিদরা বহুকাল ধরে মিডলমিস্ট এর মত অন্য কোন প্রজাতির ফুল খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে। যত দিন না পাচ্ছে এ রকম কোন প্রজাতি, ততদিন এ ফুলটিই পৃথিবীর বিরলতম ফুল।
২. জেড ভাইন (Jade Vine)
জেড ভাইন হলো শিম ও মটরশুটি বর্গের বিরল প্রজাতির ফুল। শুধু ফিলিপাইনের রেইনফরেস্টে এটির সন্ধান পাওয়া যায়। জেড ভাইন নামক এই ফুলটি দেখতে অনেকটা বাঁকা নখের মত যেটা তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এ ফুলের রং ব্লু থেকে হালকা সবুজ রঙের হতে পারে।
জেড ভাইনের পরাগায়ন বাদুর এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। পরাগায়নের প্রয়োজনেই এ ফুল রাতের অন্ধকারে উজ্জল দীপ্তিমান হয়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এবং শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে পরাগায়ন হয় জন্যই বুঝি জেড ভাইন এত দুর্লভ।
৩. কর্পস্ ফ্লা্ওয়ার (Corpse Flower)
কর্পস্ ফ্লা্ওয়ার বা শব ফুল পৃথিবীর সবথেকে বড় এবং দুর্গন্ধযুক্ত ফুল। এই বিশালাকৃতির ফুলটি যখন ফুটতে থাকে, তখন পঁচা মাংসের মত একধরণের বিশ্রী গন্ধ ছড়ায়। শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ার রেইনফরেস্টে এ ফুল দেখতে পাওয়া যায়। কর্পস ফ্লাওয়ার ৩০-৪০ বছরে মাত্র একবার ফোটে।
কর্পস্ ফ্লাওয়ার এর পাতা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এ ফুলের বাইরের দিকের রং সবুজ, আর ভেতরের দিকে গাঢ় লাল। কর্পস ফ্লাওয়ার অত্যন্ত বিরল বলে যেসব বোটানিকাল গার্ডেনে এ ফুলের চাষ করা হয় সেগুলোকে, প্রধানত, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা গার্ডেনকে আইন দ্বারা সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে।
৪. হলুদ ও বেগুনি লেডি স্লিপার (Yellow and Purple Lady Slippers)
হলুদ এবং বেগুনি রংয়ের এই অর্কিডটি প্রধানত লন্ডনে পাওয়া যায়। এটি অর্কিড পরিবারের সবচেয়ে বিরল সদস্য। লেডি স্লিপারের এই হলুদ আর বেগুনি কম্বিনেশনটা খুবই বিরল। এ ফুলের চার ভাগের তিন ভাগই হলুদ, আর বাকি এক ভাগ বেগুনি। এটি যে শুধু পৃথিবীর বিরলতম ফুলগুলোর একটি তাই নয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ফুলগুলোরও একটি। একারণেই এই হলুদ ও বেগুনি লেডি স্লিপারকে লন্ডনে আইন দ্বারা সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে।
৫. ইউটান পলুও (Youtan Poluo)
ইউটান পলুও ফুলটা খুব অদ্ভূত ধরণের। বলা হয়, এ ফুল প্রতি ৩০০০ বছরে মাত্র একবার ফুটে। এটা নিয়ে অনেকরকম গল্প প্রচলিত আছে। গল্পগুলোতে বলা হয়, ইউটান পলুওর গাছে ফুল ফোটাটা বুদ্ধের পুনর্জন্মের ইঙ্গিত দেয়। এ কারণেই এটা ফুটতে এতো বেশি সময় লাগে।
অবশ্য, ইউটান পলুও কে দেখতে ঠিক ফুলের মত মনে হয় না। এটা খুবই ক্ষুদ্র এবং এর থেকে চন্দন কাঠের মত গন্ধ আসে। মি. ডিং নামক একজন চাইনিজ কৃষক এই বিস্ময়কর ফুলটি প্রথম আবিষ্কার করেন। ইউটান পলুও চীন, কোরিয়া, তাইওয়ান, এবং যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায়। ইউটান পলুওর বিকাশ এর পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচনের জন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানিরা অনেক গবেষণা করছেন। দূর ভবিষ্যতে কোন একদিন হয়ত জানা যাবে এ বিরল ফুলের জন্মানোর পেছনের রহস্য।
৬. প্যারোটস্ বিক (Parrot’s beak)
”প্যারোটস্ বিক” যার বাংলা অর্থ করলে হয় টিয়াপাখির ঠোঁট। এটা দেখলে বোঝা যায় এটার নামকরণ কতটা সার্থক। সন্দেহাতীতভাবে এ ফুল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলগুলোর একটি। এই ফুল বসন্তকালে ফোটে এবং এর জন্য স্নিগ্ধ আবহাওয়া দরকার হয়। তাপমাত্রার উঠানামার কারণে এ ফুলের মৃত্যু হতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনক হলো. আমরা খুব কম সময়ের মধ্যে সম্ভবত এই নয়নাভিরাম ফুলটাকে চিরতরে হারাতে যাচ্ছি। বর্তমানে প্যারোটস্ বিক এর খুব অল্প কিছু প্রজাতি পৃথিবীতে আছে। ১৮৮৪ সাল থেকে এ ফুল কমতে শুরু করেছে। আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ক্যানারি দ্বীপে টিকে থাকা এ ফুলটিও আইন দ্বারা সুরক্ষিত।
৭. চকলেট কসমস (Chocolcate Cosmos)
বিরল কিন্তু মনোমুগ্ধকর চকলেট কসমস মেক্সিকার একটি স্থানীয় ফুল। এ ফুল ফোটার সময় চকলেটের মত যে সুন্দর গন্ধ বের হয়, তার থেকেই এর চকলেট কসমস নামটির উৎপত্তি। এটি গাঢ় লাল বা বাদামী রংয়ের হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের শেষদিকে শেষবিকেলে ফোটে এ ফুল।
এই অনন্য সুন্দর চকলেট কসমস দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। ১৯০২ সালে উদ্ভিতজগৎ রক্ষার জন্য পরিচালিত এক প্রচারণার মাধ্যমে এ ফুলের চাষ পুনরায় শুরু হয়। বর্তমানে এ ফুলের যে প্রজাতি টিকে আছে সেটা হলো আসল চকলেট কসমস এর ক্লোন। যে স্থানে এই ফুলের চাষ করা হয় সেই স্থানগুলোও সুরক্ষিত।
৮. ঘোস্ট অর্কিড (Ghost Orchid)
ঘোস্ট অর্কিডও বিরল প্রজাতির ফুল যেটা দেখতে অনেকটা মাকড়সার জালের মত। কিউবা ও ফ্লোরিডাতে এ ফুল জন্মে। নিজ থেকে না জন্মালে এ ফুলের চাষ খুবই কঠিন। এটার জন্য উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতার দরকার হয়। শুধু এরকম নির্দিষ্ট এক আবহাওয়াতে জন্মানোর কারণেই এটি পৃথিবীর বিরল ফুলের একটি।
দুষ্প্রাপ্যতা ছাড়াও আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কারণে ঘোস্ট অর্কিড বিখ্যাত। এ ফুলের কোন পাতা নেই। এর বোঁটা এবং ফুলের রং কিছুটা সবুজাভ। পাতা নেই বলে এ ফুল নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। এটা অন্য কোন উদ্ভিদের সাথে আগাছা হিসেবে জুড়ে যায় এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে। ঘোস্ট অর্কিড এপ্রিল ও আগস্টের মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র তিন সপ্তাহের জন্য ফোটে। এ ফুল ফোটার সময় সাবানের মত সুন্দর গন্ধ ছড়ায়।
৯. ক্যাম্পিয়ন (Campion)
ক্যাম্পিয়ন শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল জিব্রালটারে দেখতে পাওয়া যায়। এ ফুলের ঘ্রাণ খুব হালকা, পড়ন্ত বিকেলে ফোটে এবং স্বল্পায়ু হয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯২ সালে জিব্রাল্টার এর বোটানিকাল বিভাগ ঘোষণা করে যে, সেখানে আর কোন ক্যাম্পিয়ন ফুল নেই, বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু, তার দুই বছর পর ১৯৯৪ সালে জিব্রাল্টারের একজন পর্বতারোহী দুর্গম একটি এলাকায় আবার ফুলটি আবিষ্কার করেন। বর্তমানে শুধুমাত্র জিব্রাল্টার ও লন্ডনের বোটানিকাল গার্ডেনে ক্যাম্পিয়ন ফুল দেখতে পাওয়া যায়, তা ও আবার খুব অল্প সংখ্যক।
১০. কাদুপুল ( Kadupul Flower)
দুষ্প্রাপ্যতা ও সৌন্দর্য এ দুটি গুণের কারণেই কাদুপুল অনেক বেশি অসাধারণ একটি ফুল। এই অসম্ভব সুন্দর ফুলটি শ্রীলংকার বনে দেখতে পাওয়া যায়। খুব কম মানুষের ই এ ফুলের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কারণ, এ ফুল শুধু মধ্যরাতে ফোটে এবং সকাল হওয়ার পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায়। কাদুপুল ফুল ফোটার জন্যও বিশেষ আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়।
কাদুপুল ফুল এর যেমন রয়েছে সু্ন্দর রুপ, তেমনি আছে এর সুন্দর ঘ্রাণ। কম সময় বাঁচে বলে এ ফুল ভীষণ দুর্মূল্য। কেন এত কম সময় বেঁচে থাকে কাদুপুল ফুল তার কোন ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কোন উদ্ভিদবিদ দিতে পারেনি।